কারাগারের রোজনামচা বুক রিভিউ- লেখকঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বইয়ের নামঃ কারাগারের রোজনামচা
লেখকঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
কারাগারের রোজনামচা বুক রিভিউ
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনে যার অবদান অনস্বীকার্য। “কারাগারের রোজনামচা “বইটি শেখ মুজিবুর রহমান এর ২য় বই। এই বইয়ের নামকরণ করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা। ১৯৬৬-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দি ছিলেন। যদিও মাঝেমধ্যে মুক্তি পেত তবে পুনরায় জেলগেট থেকেই গ্রেফতার করে আবার জেলে প্রেরণ করত। এই বইয়ে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখা খাতার( যেটি কারাগারের রোজনামচা) নামকরণ করেন ,
” থালা বাটি কম্বল
জেল খানার সম্বল।”
বঙ্গবন্ধু এই বইয়ের শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধু বিস্তাটিত ধারণা তুলে ধরেন জেল কী? কয় ধরনের জেল আছে? কেমন সাজা হলে কোন জেলে রাখে?জেলের বিভিন্ন নিয়ম কানুন, আইন, কয়েদিদের বিভিন্ন দফার কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। জেলের ভিতর বিভিন্ন ধরনের টার্ম ব্যবহার করা হয় যেগুলো সাধারণত যারা কখনো জেলে যায় নি তাঁরা বুঝতে পারবেন না। বঙ্গবন্ধু ও প্রথমদিকে খুব একটা বুঝতে পারতেন না। তবে বহুদিন জেল জীবন কাটাতে কাটাতে সব দফা সম্পর্কে জেনে নেন।
বঙ্গবন্ধু কে অনেক জুলুম সহ্য করতে হয়েছে জেলে। নিয়মের বাইরে গিয়ে জেল কর্তৃপক্ষ (যদিও উপর মহল থেকে যা হুকুম পেত জেল কর্তৃপক্ষ) জুলুম করেছেন বঙ্গবন্ধু কে। একাকী একটা সেলে রাখত বঙ্গবন্ধুকে। (কিন্তু কারাগারে কখনো কোনো ব্যক্তিকে ১ সপ্তাহের বেশি একাকী রাখার নিয়ম নেই।) সেই সেলটা ও ছিল পাগলদের গারদের পাশেই। সারাদিন একাকী থাকা আর রাতে পাগলের চিৎকারে নির্ঘুম রাত কাটাতে হতো প্রায়ই বঙ্গবন্ধু কে। বঙ্গবন্ধু বই আর পত্রিকা পড়েই দিন কাটাতো। জেলের ভিতর বাগান করেছিলেন সেই বাগানে একাকী বিকালে ঘুরে বেড়াতেন, মুরগী পালতেন, পাখি তাড়াতেন। নানা ভাবে একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতেন। বঙ্গবন্ধুর কারোর সাথে কথা বলার হুকুম ছিল না কারণ যদি সে গোপনে জেলের মধ্যে বিপ্লব করে ফেলে। সারাদিন সংবাদপত্র আর বই পড়েই কাটাতো । কিন্তু বই পড়ার স্বাধীনতা ও দেওয়া হতো না। বেছে বেছে বই দিত। যেসব বইয়ে রাজনীতির গন্ধ ও থাকতো সেসব বই দেওয়া হতো না। এমনকি পত্রিকার বেশিরভাগ খবরই কালো কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো।
বৈষম্য সর্বত্র দেখা যেত। এমনকি জেলে ও চলত বৈষম্য। ধনীরা পেত ভালো জেল হোক সে অশিক্ষিত। আর শিক্ষিত কারো তেমন মর্যাদা ছিল না জেলে কারণ তাদের অর্থ নেই। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা হওয়া প্রকৃত রাজনীতিবিদ এর হওয়া উচিত নয়। তাই জেলে থাকা অবস্থায় তিনি কয়েদিদের বৈষম্য দূর করতেও প্রতিবাদ করতেন। জেলারের কাছে আবেদন করতেন যদিও তেমন আশানুরূপ সাফল্য অর্জন হতো না তবুও তিনি প্রতিবাদ করতেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ” মানুষকে জেলে নিতে পারে কিন্তু নীতিকে জেলে নিতে পারে না।”
১৯৬৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা দায়ের করেছিল আইয়ুব-মোনায়েম সরকার। এই কারগারের জীবনে বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন কারগারের হাজারো কয়েদিদের জীবনযাপন, তাঁদের জেলে আসার কাহিনি, কয়েদিদের ব্যক্তিজীবন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাজনৈতিক, দেশের পরিস্থিতি, দেশের বিভিন্ন আন্দোলন, কারাগারের জীবনযাপন প্রভৃতি দিনলিপি ডায়েরি তে লিখে রাখতেন। আর এই লেখায় অনুপ্রেরণা দিতেন বেগম মুজিব। এছাড়া জেলে মোয়াজ্জেম সাহেব ও বঙ্গবন্ধু কে অনুরোধ করতেন, ‘মুজিব ভাই কিছু লিখেন।’ প্রতিবার জেলে দেখা করতে আসার সময় খাতা দিয়ে যেতেন শেখ মুজিবকে।
১৪ দিন পরপর পরিবারের সাথে দেখা করার সুযোগ পেতেন বঙ্গবন্ধু। ছেলেমেয়েরা সবাই বেগম মুজিবের সাথে আসত জেল গেটে দেখা করতে তাদের আব্বার সাথে। বঙ্গবন্ধুর কাছে সব থেকে কষ্টদায়ক ছিল ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে ছেড়ে থাকতে। আব্বা আব্বা বলে মুখরিত করে ফেলতো জেলগেটের রাস্তা দিয়ে যখন শেখ মুজিবুর রহমান আসতো। ২ বছরের ছেলে শেখ রাসেলকে স্বান্তনা দিতে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ” তোমার মায়ের বাড়ি তুমি যাও। আমার বাড়ি আমি থাকি। আমাকে দেখতে আবার আসিও। শেখ রাসেল বুঝে গেছে তাঁর আব্বার বাড়ি জেলখানা। আমি আমার বাড়ি থাকব পরিবারের সাথে যখন দেখা করতেন তখনও অফিসাররা দাঁড়িয়ে থাকতেন যদি পরিবারের সাথে রাজনৈতিক যুক্তি করেন।
কারাগারের রোজনামচা বইয়ে বঙ্গবন্ধু মাওলানা ভাসানী সাহেবের বিষয়ে অনেক তথ্য তুলে ধরেছেন। মাওলানা ভাসানী ৬দফা আন্দোলন সমর্থন করতেন না তবে স্বায়ত্তশাসন সমর্থন করতেন কারণ তাঁর পার্টির জন্ম হয়েছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবির মাধ্যমে। তাছাড়া মাওলানা ভাসানী সাহেব কখনো মাওলানা পাশই করেননি তবুও তিনি নামের পাশে মাওলানা ব্যবহার করতেন। যদি কেউ তাঁকে মাওলানা সম্বোধন না করতেন তবে তিনি বেজার হতেন।
কারাগারে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পবিত্র ইদ পালনেও হস্তক্ষেপ করত জেল কর্তৃপক্ষ। ১৯৬৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ইদ সরকারের হুকুমে জেলে ১২ ফেব্রুয়ারিতে পালন করতে হয়েছিল। স্ত্রী রেণুকে উদ্যেশ্য করে বলেছিলেন,
“চিন্তা করিও না।।জীবনের বহু ঈদ এই কারাগারে কাটাতে হয়েছে, আরো কত কাটাতে হয় ঠিক কি? তবে কোনো আঘাতেই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোঁদা সহায় আছে।”
বঙ্গবন্ধু জেলখানায় অনেকবার অসুস্থ হয়েছেন কিন্তু কখনোই মনোবল হারাননি। একবার মায়ের অসুস্থতায় খুব ভেঙে পড়েন। একাকী সারারাত জেগে কাটিয়ে দেন। কিন্তু আপিল করেও মায়ের সাথে দেখা করার সুযোগ পাননি। বঙ্গবন্ধুর কোনো স্বার্থ নাই,লাভ নাই তারপরও তিনি দেশের মানুষের জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করছেন। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো জেলে কাটিয়েছেন। কত কষ্ট সহ্য করেছেন শুধু এদেশের মানুষের অধিকার আদায় করার জন্য। দেশকে ভালোবেসে তাই বলেছিলেন,
” তোমাকে আমি ভালোবাসি। মৃত্যর পর তোমার মাটিতে যেন আমার একটু স্থান হয়, মা।”
মূলত ৬ দফা আন্দোলন ঘোষণা করার পরপরই বঙ্গবন্ধু কে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে বেশিরভাগ মামলাই ছিল বক্তৃতার মামলা যা নাকি দেশদ্রোহী বিবৃতি ছিল। ৬দফা আন্দোলন এক দফায় পরিণত হয় সেই এক দফাই হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সামরিক গোষ্ঠী ৬দফাকে ৮ দফায় রুপান্তর করে আন্দোলন কে ভিন্নখাতে নিয়ে যাবার চেষ্টা ও করেছিলেন। শেরে বাংলা ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব করেন তাঁর প্রস্তাবেই পাকিস্তান পেয়েছিলেন। আর ৬ দফা পেশ করা হয়েছিল লাহোর প্রস্তাব এর ওপর ভিত্তি করে। ৭ই জুন ৬দফা দিবস পালন করা হতো কিন্তু সরকার ঐদিন ১৪৪ ধারা জারি করেছিল।
১৭মাস একা কারাবাস করার পরে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এডভোকেট আব্দুল মোমিন কে শেখ মুজিবুর রহমান এর জেলের কামরায় দেওয়া হয়। এরপর ই বঙ্গবন্ধু কে মুক্তি দেওয়া হয় এবং পুনরায় জেলগেট থেকে গ্রেফতার করেন সামরিক বাহিনী। এরপর আর লিখতে পারেননি শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু সেই সময়ের নেতাদের ডেফিনেশন দিয়ে বলেছিলেন, গুন্ডার পরে পান্ডা, পান্ডার পরে নেতা।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবন অনুধাবন করে লিখেছেন, ” কোনো ব্যথাই আমাকে দুঃখ দিতে পারে না এবং কোনো আঘাতই আমাকে ব্যথা দিতে পারে না।”
তিনি এদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন,” যে দেশের মা ছেলে বিক্রি করে পেটের দায়ে, যে দেশের মেয়েরা ইজ্জত দিয়ে পেট বাঁচায়, সে দেশ ও স্বাধীন এবং সভ্য দেশ!!! গুটিকয়েক লোকের সম্পদ বাড়লেই জাতীয় সম্পদ বাড়া হয় বলে যারা গর্ব করে তাদের সম্বন্ধে কি-ইবা বলব!!
বঙ্গবন্ধু নেতাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা দেখে প্রশ্ন করেন, ” আমার ঘর থেকে যদি চুরি করতে আমিই সাহায্য করি সামান্য ভাগ পাওয়ার লোভে তবে চোরকে দায়ী করে লাভ কী?” তিনি হাস্যরসাত্মকভাবে বলেন, “চোর নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী।”
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের পরিচয় (১৯৫৫-১৯৭৫) তুলে ধরেছেন বইয়ের শেষাংশে। বঙ্গবন্ধুকে জানার জন্য খুবই তথ্যবহুল বই “কারাগারের রোজনামচা”। একজন নেতা যিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। বহুবার জেল খেটেছেন। অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। যেই বাংলার মানুষের জন্য এত ত্যাগ করেছেন সেই বাংলার মানুষ ই ষড়যন্ত্র করে তাঁকে পরিবারসহ নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে জানতে এই বইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কারাগারের রোজনামচা বুক রিভিউ